
টাইমস আই বেঙ্গলী ডটনেট, ঢাকা: ইউক্রেনে টানা ৯ দিন ধরে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে রুশ সেনারা। এই অভিযানে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির কয়েক’শ বেসামরিক মানুষ মারা গেছে, ১০ লাখের বেশি শরণার্থী হয়েছে। সামরিক হামলার পাশাপাশি ইউক্রেনে ৪০০ ভাড়াটে গুপ্তঘাতক পাঠিয়েছে রাশিয়া। ওইসব ভাড়াটে গুপ্তঘাতকরা কিলিং মিশনে অংগ্রহণ করছে।
ইউক্রেনের জেপোরোজিয়া পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র দখলে নিয়েছে রাশিয়া। তীব্র লড়াইয়ের পর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি দখলে নেয় রুশ সেনারা। ইউক্রেনের এই পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পুরো ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বড়। এর আগে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ভবনে রাশিয়ার বোমা হামলায় সেখানে আগুন ধরে যায়। বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, রাশিয়ার দখলে যাওয়ার পর কর্মীরা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। তারা আরও জানিয়েছে, পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মীরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং বিদ্যুৎ ইউনিটগুলোর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন। এর আগে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ভবনে রাশিয়ার বোমা হামলায় সেখানে আগুন ধরে যায় বলে জানিয়েছিল ইউক্রেনের কর্মকর্তারা। সেসময় এই পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশপাশে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সৈন্যদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষেরও খবর সামনে আসে। আগুন লাগার পর আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছিল, তারা ইউক্রেনের কর্মকর্তাদের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন এবং জানতে পেরেছেন যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির অপরিহার্য অংশগুলো এখনও চলমান আছে।
এদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুন লাগার খবরে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানিমন্ত্রী জেনিফার গ্রানহোম টুইটারে লেখেন, ইউক্রেনের জেপোরোজিয়া পারমাণবিক কেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে তিনি ইউক্রেনের জ্বালানিমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। জেনিফার বলেন, তিনি মার্কিন নিউক্লিয়ার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিমকে সক্রিয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গ্রানহোম বলেন, পারমাণবিক কেন্দ্রের কাছে রাশিয়ার সামরিক অভিযান অত্যন্ত বেপরোয়া পদক্ষেপ এবং এটি শেষ হওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, মার্কিন পারমাণবিক নিয়ন্ত্রণ কমিশন এবং হোয়াইট হাউসের সঙ্গে পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। অবশ্য আগুনের ঘটনায় ওই পারমাণবিক কেন্দ্রে বিকিরণের মাত্রা বাড়েনি বলেও জানান তিনি।
ইউক্রেনের উত্তরাঞ্চলীয় একটি শহরে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর হামলায় ৩৩ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ১৮ জন। পূর্ব ইউরোপের এই দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় চেরনিহিভ শহরে বৃহস্পতিবার রুশ বাহিনী স্কুলসহ বহুতল আবাসিক অ্যাপার্টমেন্টে হামলা চালালে প্রাণহানির এই ঘটনা ঘটে। শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি। চেরনিহিভ শহরটি ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে ১২০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। উত্তর দিক থেকে এই শহরটিতে ব্যাপক হামলা চালাচ্ছে রুশ সামরিক বাহিনী। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে ইউক্রেনে ঢুকে হামলা শুরু করে রাশিয়ান সৈন্যরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে ইউক্রেনে এই হামলা শুরু করে। একসঙ্গে তিন দিক দিয়ে হওয়া এই হামলায় ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছে বৃষ্টির মতো।
সর্বাত্মক হামলা শুরুর পর এই এক সপ্তাহেই পূর্ব ইউরোপের এই দেশটির বহু শহর কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সামরিক অবকাঠামোর বাইরে রাশিয়ার হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে আবাসিক ভবন, স্কুল ও হাসপাতাল। আর তাই জীবন বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ১০ লাখেরও বেশি ইউক্রেনীয়। চেরহিনিভ শহরের ডেপুটি মেয়র রেজিনা গুসাক এএফপিকে জানিয়েছেন, শহরে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী বোমা হামলা করেছে। এদিকে চেরহিনিভ শহরে রুশ হামলার বেশ কিছু ছবি সামনে এনেছে ইউক্রেনের জরুরি বিষয়ক দফতর।
রুশ হামলায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অ্যাপার্টমেন্টগুলো থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেরিয়ে আসছে এবং ভবনের ধ্বংসাবশেষ চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এছাড়া উদ্ধারকারীদেরকে স্ট্রেচারে করে হামলায় নিহতদের মৃতদেহও বহন করতে দেখা যায়। চেরনিহিভ অঞ্চলের গর্ভনর ব্যাচেস্লাভ চাউস টেলিগ্রামে বলেন, ‘রুশ যুদ্ধবিমান চেরনিহিভের স্টারায়া পদুসিকভা এলাকায় দু’টি স্কুলে এবং সেখানকার বাড়ি-ঘরে হামলা চালিয়েছে। উদ্ধারকারীরা ওই এলাকায় কাজ করছেন।’এক সপ্তাহের বেশি সময় আগে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ চালালেও মস্কো বরারবরই দাবি করছে যে, তারা বেসামরিক এলাকাগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে না। যদিও রুশ এই দাবির বিপরীতে ব্যাপক প্রমাণ রয়েছে।
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় মারিউপল শহর অবরুদ্ধ করে রেখেছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী। একইসঙ্গে শহরটিতে বোমা হামলা অব্যাহত রেখেছে রুশ সেনারা। এছাড়া শহরটিতে বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার পাশাপাশি খাবার সরবরাহও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে আলজাজিরা। এছাড়া পূর্ব ইউরোপের এই দেশটির আরও বহু শহরে চলছে রুশ হামলা। দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় চেরনিহিভ শহরে বৃহস্পতিবার রুশ বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছেন ৩৩ জন। মারিউপল শহরের মেয়র ভাদিম বয়চেঙ্কো বলেছেন, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী মারিউপল অবরুদ্ধ করে রেখেছে রুশ সামরিক বাহিনী। একইসঙ্গে অবরুদ্ধ করার পাশাপাশি বিদ্যুৎ, পানি, খাবার ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে তারা। তিনি আরও বলেছেন, গত ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে শহরটি অবরুদ্ধ করে রাখার পাশাপাশি অব্যাহত ভাবে হামলা চালানো হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের হাতে রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর লেনিনগ্রাদ অবরোধের কথা উল্লেখ করে ভাদিম বয়চেঙ্কো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘লেনিনগ্রাদের মতো করে এখানে তারা অবরোধ আরোপের চেষ্টা করছে।’ নাৎসিদের হাতে রুশ শহর লেনিনগ্রাদ অবরোধের কারণে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। মারিউপল শহরের মেয়র আরও বলেন, ‘(বিচ্ছিন্ন করার পর) তারা আমাদের বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ মেরামত করতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। রুশ সৈন্যরা আমাদের রেল সংযোগও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে যেন আমরা নারী, শিশু এবং বয়স্ক নাগরিকদের সরিয়ে নিতে না পারি।’
মারিউপলের সিটি কাউন্সিল জানিয়েছে, রাশিয়া ক্রমাগত এবং ইচ্ছাকৃতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক অবকাঠামোতে গোলাবর্ষণ করছে এবং প্রয়োজনীয় পণ্য বা সেবা সরবরাহে এবং লোকজনকে সরিয়ে নিতে বাধা দিচ্ছে।
অপরদিকে, ইউক্রেনে টানা ৯ দিন ধরে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে রুশ সেনারা। এই অভিযানে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির কয়েক’শ বেসামরিক মানুষ মারা গেছে, ১০ লাখের বেশি শরণার্থী হয়েছে। সামরিক হামলার পাশাপাশি ইউক্রেনে ৪০০ ভাড়াটে গুপ্তঘাতক পাঠিয়েছে রাশিয়া। দ্য টাইমসের বরাত দিয়ে নিউ ইয়র্ক পোস্টের প্রতিবেদনে এমনটাই দাবি করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে ৪০০ জনের বেশি ওয়াগনার গ্রুপের সদস্য রয়েছে। তারা ইউক্রেনে ২৪ জন কর্মকর্তাকে ‘হত্যার তালিকা’ নিয়ে দেশটিতে প্রবেশ করেছে। ওই কর্মকর্তাদের হত্যা করা গেলে ইউক্রেন সরকারে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। একটি কূটনৈতিক সূত্র সংবাদপত্রকে বলেছে, গুপ্তঘাতকরা ইউক্রেনে একটি খুব হাই-প্রোফাইল মিশনে যাবে। একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার সেই মিশন রাশিয়ানরা অস্বীকার করতে পারবে। কূটনৈতিক সূত্রটি আরও জানায়, তাদের জন্য এটাই হবে সম্ভবত এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মিশন। এটা যুদ্ধের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
ওই গুপ্তঘাতকরা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে অন্তত তিনবার হত্যার চেষ্টা করেছে। ৪৪ বছর বয়সী ভলোদিমির জেলেনস্কি গত শনিবার কিয়েভের উপকণ্ঠে একটি হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে যান। তার কাছে পৌঁছানোর আগেই চেচেন হত্যাকারীদের একটি দলকে সেখান থেকে বের করে আনা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর দুটি ভাড়াটে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে তিনবার হত্যার চেষ্টা করে। তবে রাশিয়ার ভাড়া করা সেই গোষ্ঠীর পরিকল্পনা সফল হয়নি। ইউক্রেনের জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সচিব স্থানীয় টিভি স্টেশনগুলোকে বলেন, ‘আমি বলতে পারি যে, আমরা (রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস) থেকে তথ্য পেয়েছি, যারা এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অংশ নিতে চায় না’। দ্য টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই হত্যাচেষ্টার পেছনে ছিল ক্রেমলিন-সমর্থিত ওয়াগনার গ্র“প। জেলেনস্কিকে তারা যদি হত্যা করতে সফল হতো, তাহলে মস্কো এই হত্যার ষড়যন্ত্রে সরাসরি জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করতে পারত। কমেডিয়ান থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া ভলোদিমির জেলেনস্কি ইতিহাসের কঠিনতম সময়ে ইউক্রেনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়ার বিরুদ্ধে এখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তার সেনাবাহিনী। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর কিয়েভ থেকে জেলেনস্কিকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।