নবিউল ইসলাম,মুর্শিদাবাদ,পশ্চিমবঙ্গ
ভারতবর্ষে লিখিত ইতিহাস চর্চার কাজটি ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল এ বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিমত আছে। মুসলমানদের আগমনের পূর্বে যে সব রচনা পাওয়া যায় সেই সব রচনা ও মূল্যবান গ্রন্থগুলি ভারতীয় ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। পরবর্তীকালে ইতিহাস রচনার উপাদান সংগ্রহের ক্ষেত্রে ওই সব রচনাগুলি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে। ওই রচনাগুলি সম্পর্কে আমরা যতটা জানতে পারি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলি ছিল জীবনীগ্রন্থ ও সমাজ-বিজ্ঞান-বিষয়ক গ্রন্থ। অশ্বঘোষ-এর ‘বুদ্ধচরিত’, বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’, ‘কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ বাৎসায়নের ‘কামশাস্ত্র’ এসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য রচনা এবং ভারত-ইতিহাসের আকরগ্রন্থ। এর সঙ্গে যোগ করা যেতে পারে হিউয়েন সাঙ, ফা হিয়েন প্রভৃতি পরিব্রাজকদের ভারত-সম্পর্কিত কিছু রচনা। বাবর বা জাহাঙ্গীরের মতো আত্মজীবনী প্রাক-মুসলিম যুগের ভারতীয় সম্রাটরা কেউ লিখেছেন বলে তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু, সম্রাট অশোকের গোটা ভারত জুড়ে যে শিলালিপিগুলি মুদ্রিত করেছিলেন তা ভারতীয় ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে আছে। প্রাক-মুসলিম যুগের ইতিহাস অনেকটা অনুমান-নির্ভর। সেই যুগে প্রামাণ্য কোন ইতিহাসগ্রন্থ রচনা না হওয়ায় ওই সব জীবনী গ্রন্থ, অর্থশাস্ত্র, মুদ্রিত শিলালিপির উপর নির্ভর করে প্রাচীন যুগের ভারতীয় ইতিহাসের একটি রেখাচিত্র অঙ্কন করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
মোঘল আমলের পূর্বে মুসলিম শাসনের সময় অনেক ঐতিহাসিক-গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এই সময়কালের পূর্বে যে সব পরিব্রাজক ভারতে এসেছিলেন আলবিরুনী (৯৭৩—১০৪৮) তাঁদের অন্যতম। বেশ কিছুদিন তিনি ভারতে ছিলেন। ইরানীয় মুসলমান এই পরিব্রাজক গজনীর সুলতান মামুদের রাজসভায় গণ্যমান্যদের সঙ্গে উপস্থিত থাকতেন। গজনীতে থাকাকালীনই ভারত-সম্পর্কে আলবিরুনীর আগ্রহ দেখা দেয়। ভারতের বিভিন্ন জায়গা ঘুরেছেন, সংস্কৃত ভাষাও শিখেছিলেন। ভারত-সম্পর্কিত তাঁর বিখ্যাত ‘তারিখুল হিন্দ’। এ ছাড়া মিনহাজুস সিরাজ রচিত ‘তাবাকাত-ই-নাসিরী’ এবং জিয়াউদ্দিন বারানী রচিত ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী- মোঘল-পূর্ব যুগের ইতিহাস সম্পর্কে বিখ্যাত রচনা।
ইতিহাস চর্চা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে মোঘল আমলে। মোঘল সম্রাটরা নিঃসন্দেহে ইতিহাস সম্পর্কে খুব সচেতন ছিলেন। জ্ঞানচর্চার প্রতিও তাঁরা ছিলেন যত্নবান। মোঘল সম্রাটদের দরবার হয়ে উঠেছিল জ্ঞানী মানুষদের অবাদ বিচরণ ক্ষেত্র। এসব থেকে ইতিহাস রচনা একটা পূর্ণ মাত্রা পায়। সম্রাট বাবর যে আত্মজীবনী লিখেছিলেন তা ইতিহাস বিখ্যাত হয়ে আছে। বাবরের সেই আত্মজীবনীতে তৎকালীন ভারত, আফগানিস্তান, তুর্কি প্রভৃতি দেশের সামাজিক ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আছে। হুমায়ূন নিজে কিছু না লিখলেও আকবরের অনুরোধে হুমায়ুনের ভগ্নী গুলবদন বেগম লিখেছিলেন হুমায়ুনের জীবনী ‘হুমায়ুন নামা’। জওহর আফতাবচীও হুমায়ুনের একটি জীবনী লিখেছিলেন। ‘তাজকিরাতুল ওয়াকিয়াত’ নামে এই গ্রন্থটিও বিখ্যাত ঐতিহাসিক গ্রন্থ। জওহর আফতাবচী ছিলেন সম্রাট হুমায়ুনের ঘুব ঘনিষ্ট মানুষ। হুমায়ুনের ব্যবহারের প্রয়োজনীয় জল সরবরাহের দায়িত্ব ছিল তাঁর। আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল লিখেছিলেন ‘আইন-ই-আকবরী’ এবং ‘আকবর নামা’। আকবরের আমলে তাঁর সাম্রাজ্যের জরীপ কাজ হয়েছিল তোড়লমল্লের পরিচালনায়, যে জরীপ কার্যের লিপিবদ্ধ রিপোর্ট বিখ্যাত হয়ে আছে। ইতিহাস ও সাহিত্যকর্ম হিসাবে তাৎপর্যমন্ডিত ‘তুজুক-এ-জাহাঙ্গীরা’ নামে সম্রাট জাহাঙ্গীরের লেখা আত্মজীবনী। ভারতীয় কৃষি ও সেচ ব্যবস্থা, কর ব্যবস্থা ও শাসন ব্যবস্থার উপর একটি আকর গ্রন্থ ‘ফতেয়ায়ে-আলমগিরী’ রচিত হয়েছিল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে। এছাড়া মোঘল সম্রাটদের আমলে ঐতিহাসিকগণ আরও কিছু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মীর্জা নাথানের ‘বাহিরীস্তান-ই-গায়েবী’। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে লেখা হয়েছিল বাঙলার উপর এই উল্লেখযোগ্য গ্রন্থটি। জাহাঙ্গীরের রাজত্বের শেষ দিকে যে সব বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল তা লিপিবদ্ধ আছে এই গ্রন্থটিতে। ঐতিহাসিক সৈয়দ গোলাম হুসাইন খান তাবতাবায়ী ‘সিয়ারে মুখতাখখিরীন’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যু-পরবর্তী পর্যায়ে একেবারে আলিবর্দী খানের সময় পর্যন্ত বিস্তারিত ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে এই গ্রন্থে। এই সময়ের ইতিহাস গবেষণার ক্ষেত্রে গ্রন্থটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
————————–
সূত্র :
১। অনীক, জুলাই ২০০১।
২। ‘বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ইতিহাস চেতনার অসাড়তা’, বদরুদ্দীন উমর
(অনীক, ২০০১ সংখ্যায়)।